তিস্তাপারের বৃত্তান্ত: গাজলডোবা ২০১৯
|| “হে হৃদয়, একদিন ছিলে তুমি নদী” ||
এখানে মেঘ গাভীর মত চরেছিল। এখন, বসন্তের শুরুতে, চরাচর জুড়ে শুধু জল আর জল । কোথাও কোথাও শর আর নলখাগড়ার জঙ্গল। কাছে গেলে আঁশটে গন্ধ পাওয়া যায়।
নদীর চরিত্র এখানে জটিল। পাহাড়ের উপরে বাবুদের বাঁধ নিয়ন্ত্রণ করে এখানে জলের আগমন, নির্গমন। বিরক্তি, তিক্ততা আর ঘেন্নায় তিস্তা এখানে তাই কুটিলা, জঙ্গম, পৃথুলা।
জল আর জমির দ্বন্দ্ব অহর্নিশ হেথায়। তাই জলের জটিলতা সংক্রমিত আজ জমির মধ্যে। তার মতিস্থির নেই। আজ যা জেগে আছে, কাল ডুব দেবে তিস্তার বুকে। তবু নৌকার তলায় বালি দেখা যায়। বৈঠার কাজ নেই, কেবল লগির ঠেলায় চলাচল।
নৌকা নেমেছে সাতসকালে। ঠাকুর মালো কাণ্ডারি। চেহারা একহারা। সন্দেহ হয়, সারাদিন লগি ঠেলতে পারবে কিনা। কিন্তু পাখি চেনে বিলক্ষণ।
সব খবর রাখে। কোন হাঁস এবার দলছুট হয়ে পথ ভুলে একা একা, কোন পাখি ছটফটে, কোন বেলায় আলো পড়বে সঠিক কোণে, কোন পাখির কালো মাথায় সবুজ ঝিলিক, - সব নখদর্পনে।
তাই এই বিচরণ। তিস্তা বুড়ির শরীরের আনাচে কানাচে এপার ওপার । অপার আকাঙ্ক্ষা অতিথিদের দেখার।
রোদ শরের ডগা স্পর্শ করেছে মাত্র। রাঙামুড়ি (রেড ক্রেস্টেড পোচার্ড), আর টিকিহাঁসের (টাফটেড ডাক) অনায়াস অলস সন্তরণ। কাছে গেলেই সন্দিহান বলাকা আর সংকুল উড়ান। ডানা থেকে জলের বিন্দু ঝরে পড়ে।
“উই দ্যাখেন। স্মিউ। একখানাই আসছে। মেয়ে।” ঠাকুর জানালো। তা দেখা গেল। ছোট একখানি হাঁস। অন্যদের দলে ভাসছে।
পথ এখানে সরু হয়ে এসেছে। দুপাশে নলবন। কিন্তু আগামীতে তিস্তাবুড়ির বিস্তার।
চরে বসে চখাচখি - রাডি শেলডাক। ঝাঁকে নয়, জোড়ায় জোড়ায়। গেরুয়া শরীরে অহংকার, গম্ভীর ডাকে গর্ব।
পেরিয়ে যায় দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি। পড়ে আছে নিস্তরঙ্গ চাদরের মতো।
দেখা হলো আবার এক বিরহিণী হংসিনীর সাথে। ইনি কমন শেলডাক। নামে ‘কমন’ অর্থাৎ সাধারণ। কিন্তু দেখা পাওয়া সহজ নয়। এখনো পর্যন্ত একজনই এসেছেন। স্বভাবে অবশ্য বিরহিণীসুলভ কোমলতা দেখা গেল না। একজোড়া চখাচখির দিকে কিঞ্চিৎ খিঁচিয়ে তেড়ে গেলেন। বিরহতাপে অন্যের সুখ বিশেষ সহ্য হচ্ছে না বুঝি।
নৌকা ঢুকে পড়েছে আবার এক শরবনে। মাঝে মাঝেই দেখা রাঙামুড়ি, টিকিহাঁস আর পাতি তিলিহাঁসের (কমন টিল) দল। মাঝে মাঝে দুএকটা খুন্তেহাঁস (নর্দার্ন শোভেলার)। এরা লাজুক। নৌকা দেখলেই দে দৌড়।
কিন্তু ঠাকুরমাঝি যেন অন্যমনস্ক। হাতের তালুতে রোদের আড়াল করে দূরে নজর। কেন এই উচাটন?
হঠাৎ তার শীর্ণ মুখে হাসির আঁকিবুকি। “দ্যাখেন দেখি নজর করে। উই দূরের ওই দলে। আছে না একখান সবুজ পানা?”
আছে তো। নিশ্চয় আছে। ধূসর দেহ। পান্না সবুজ মাথায় প্রায় ধাতব ঝিলিক। ফালকেটেড ডাক।
“এটাও আসছে একখান মোটে। তবে মদ্দা।“ একমুখ বিড়ির ধোঁয়া ঢাকতে পারে না পরিতৃপ্তির হাসি। এই শরের জঙ্গলে লগি ঠেলে একে খোঁজা তো খড়ের গাদায় সুঁচ। ওস্তাদ বটে গো তুমি মাঝিভাই।
নৌকা বেরিয়ে তিস্তা বুড়ির বুকে। যেখানে জল আর বালি মিলে মিশে একাকার, সেখানে এক ঝাঁক উত্তুরে টিট্টিভ (নর্দার্ন ল্যাপউইং)। গায়ে ব্রোঞ্জের ঝিলিক, মাথায় টিকি। অপরূপ।
একটু অন্যদিকে মুখ ঘোরে তরণীর। জোরালো ডাকে সচকিত হয়ে দেখা যায় চখাচখির যুগ্ম উড়ান। তাদের মেলে দেওয়া পাখায়, ভারতীয় ত্রিবর্ণ।
অসংখ্য চরের একটিতে অপেক্ষায়, একদল দাগি রাজহাঁস (বার হেডেড গুজ)। রাজকীয় গরিমায় উপেক্ষা। নৌকার উপস্থিতিতে অবিচল। আশপাশে ঘুরছে পাতি লালপা (কমন রেডশ্যাংক), আর পাতি সবুজপা (কমন গ্রিনশ্যাংক)। ভ্রুক্ষেপ নেই তাতেও।
কোথা থেকে ভেসে আসে ডিঙি। পাহাড় থেকে ভেসে আসা কাঠ বোঝাই করে তুলেছে। দেখে মনে হয় এই বুঝি ডুবলো। কিন্তু ডোবে না।
বেলা কিন্তু ডোবে। বামদিকে ওই দেখা যায় মুক্তধারার মতো বাঁধ। নদীর বুক ছাপিয়ে ‘কেমন যেন স্পর্ধার মতো দেখাচ্ছে’, যেন ‘দিনরাত্তির সমস্ত আকাশকে রাগিয়ে দিচ্ছে’।
বেলাশেষে হাঁসেদের হুটোপুটি থামে নি। কোথা থেকে একজোড়া কমন পোচার্ড রাঙামুড়িদের দলে ঢুকে পড়েছে। ভূতিহাঁসের দঙ্গল এপার সেপার। একটা জলা কাপাসি (মার্শ হ্যারিয়ার) শ্যেন দৃষ্টি মেলে উড়ে যায়।
নৌকা ঘাটে লাগে।
~
|| আত্মনেপদী ||
সন্ধ্যেবেলা দেখলাম জমার হিসেব মন্দ নয়। রাঙামুড়ি, কমন পোচার্ড, টিকি হাঁস, ভূতি হাঁস, চখাচখি এসব তো পেয়েছিই। সাথে এসেছে কমন শেলডাক, স্মিউ, ফালকেটেড ডাক। আঃ। যাকে বলে 'মন খুশি উর্বশী'।
থাকার জায়গা বোরোলি হোটেল। আগে রেস্তোরাঁই ছিল। মাত্র দুমাস হলো থাকার জন্যে চারটি ঘর তৈরী হয়েছে। খাসা ব্যবস্থা।
সন্ধ্যেবেলা আমার ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধু দীপ্তিময় হাজির মালবাজার থেকে। সে এখন মস্ত সরকারি আধিকারিক। কিন্তু গত কুড়ি বছরে তার শিশুসুলভ হৈ হৈ করা স্বভাব, জমিয়ে ফেলার অভ্যেস এতটুকু বদলায় নি। তুমুল গল্প চললো।
গিন্নি আর আমি দীপ্তিময়কে নিয়ে ঢুঁ মারলাম চারদিক খোলা রেস্তোরাঁতে। সামনে শিমুল গাছে পাতা নেই। কিন্তু লালফুলগুলোতে ধাক্কা খাচ্ছে তিস্তার হাওয়া। পুকুরের ওইপারে সোলার ব্যাটারির আলো জ্বলে উঠেছে অন্ধকার হতেই। খাবার চলে এলো টেবিলে।
পোস্তর বড়া, আলু বেগুন বড়ি দিয়ে বোরোলির পাতলা ঝোল, শেষ পাতে টম্যাটো পেঁয়াজ দিয়ে ড্যাকরা (মাছ, গালি নয়)। তিস্তা থেকে সদ্য ধরা। গিন্নির নির্দেশে রান্না। কী যে অপূর্ব খেতে বলবার নয়।
বড্ডো মন ভালো হয়ে গেল। তাই রাতের দিকে দীপ্তিময়ের আনা গুড়ের রসগোল্লা খানকতক মেরে দিলাম। আরো খেতাম। গিন্নি বারণ করলো।
কালকেও তিস্তার বুকেই কাটবে মোটামুটি।
~
|| “এখানে প্রাণের স্রোত আসে যায়” ||
উজান গো, উজান আজ। বেয়ে চলা, বয়ে চলা তিস্তাবুড়ির উজানে। তাই বুঝি আজ প্রাণের স্রোত, ঢলে আসা শরীরে ভাটা পড়া যৌবনের উচ্ছলতা।
ঠাকুর মালোর খাটনি আজ বেশি। স্রোতের উল্টোদিকে যাওয়া যে! কিন্তু কেন এই পরিশ্রম?
বাঃ, মার্গেঞ্জারগুলো যে ওই উজানেই থাকে। স্রোত ছাড়া ওরা থাকতে পারে না। পাহাড়ি স্রোতে ডুব মেরেই তো ওরা মাছ ধরে আর খায়।
কিন্তু সে তো এখনো পৌনে ঘন্টার পথ। তার আগে? কেন? আছে তো। শিকারি পাখিরা। ওই যে এক পেরেগ্রিন ফ্যালকন। ধু ধু বালির চরে, একটা ভেসে আসা গাছের গুঁড়ির উপর। বসে থাকে কমন কেস্ট্রেল, জলের উপর জেগে থাকা ক্ষুদ্র দ্বীপে। তার বাদামি গায়ে কালো ছিট ছিট, চোখ পাকিয়ে থাকে নৌকার দিকে।
আর এক বালিয়াড়ির গায়ে নৌকা লাগে। দূরে অন্যপ্রান্তে ঢুকে গেছে এক সরু খাঁড়ি। শিকারি পাখির মতো তাকিয়ে নির্ভুল খুঁজে নেয় ঠাকুর মালোর চোখ। একটা মার্গেঞ্জার পরিবার।
কিন্তু ছবি উঠবে কি করে? “বালির উপর হাঁইটা যান।” সাধু প্রস্তাব মাঝি। কিন্তু উত্তরবঙ্গের নদী সম্বন্ধে সেই কবে শরদিন্দু যে চেতাবনি দিয়েছেন। তো সেই চোরাবালি আছে নাকি? “আছে একটু। বেশি না। কোমর তক ডুইববে। ডান দিক ঘেঁইষে যান।”
বলে কী! 'শুনিলে প্রাণ চমকে ওঠে' - লালন বলেছেন। আর এখন বলে আত্মারাম। কিন্তু ছবির লোভ! অগত্যা ইষ্ট স্মরণ এবং অগ্রসরণ। ওই ডান দিক ঘেঁষেই।
ছবি হলো। চরের উপর এবং নৌকা থেকে। সঠিক কোনে, আলো মেপে। পুরুষ পাখির মাথায় সবুজের ঝিলিক এনে, স্ত্রী পাখির অলস বিশ্রাম ধরে। সবই ঠাকুরের কৃপা।
ফেরা শুরু। টান জলের স্রোতে ভাটির দিকে। টান মনের স্রোতে বাটির দিকে।
হঠাৎ দিক বিদিক চমকে দেয় প্রলয়ঙ্করী শব্দ। ভূমি বিদীর্ণ করে উঠে আসে ধোঁয়ার মেঘ, স্তম্ভের মতো। উড়ে যায়, ছড়িয়ে পড়ে সংবিগ্ন পাখিকূল। বুঝি ঘিস নদীর বুকে শুরু হয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর মহড়া। কী যেন এক অশনি সংকেত।
গাজলডোবা, ভালো থেকো। ভালো রেখো তোমার পাখিদের।
***
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
দুই ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধুর কথা না বললে এই গল্প অসম্পুর্ণ থেকে যায়। দীপ্তেশ ঘোষ রায় এর অকৃত্রিম উৎসাহ আর দীপ্তিময় দাসের অকুন্ঠ সাহায্য ছাড়া আমাদের গাজোলডোবা ভ্রমণ সম্ভব ছিল না।
আর অবশ্যই ঠাকুরদাস মালো। অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে দুটি দিন পরম যত্নে পাখি দেখিয়েছেন। শুধু পাখি নয়, ফটোগ্রাফিটাও গভীরভাবে বোঝেন। পরিশ্রম করতে বিন্দু মাত্র কুণ্ঠা নেই একটা ভালো ছবি তোলার জন্য। এক পরম সম্পদ যেকোনো পাখিবাজের কাছে।
শিরোনামগুলি প্রিয় কবি জীবনানন্দের মহাপৃথিবী ( “হে হৃদয়, একদিন ছিলে তুমি নদী”), এবং রূপসী বাংলা (“এখানে প্রাণের স্রোত আসে যায়") কাব্যগ্রন্থগুলি থেকে নেওয়া যথাক্রমে ।
Comments
Post a Comment