আবার লাটপাঞ্চার 2017





সে-ই একমাস আগে কাজিরাঙা থেকে ফিরেছি। কত্বদিন আর বাড়ি থাকা যায়! অতএব চলো মুসাফির। বাঁধো গাঁটরি।

গাঁটরি তো বাঁধলাম। যাবো কোথায়? কেন! লাটপাঞ্চার। বছর দুই আগে ওখানে ধনেশগুলোকে বলে এসেছিলাম 'আবার দেখা হবে'। যাই। কথা রেখে আসি। আমাদের পাগলামির সঙ্গী জুটলো অমিত আর রূপা।

অগতির গতি পদাতিক। সেই পৌনে ঘন্টা লেট। সন্তোষ তামাঙের সুমোতে চড়ে সেবক পৌঁছতেই প্রায় এগারো। নিউ গৌতমে প্রবল ভিড়। তাই পাশেরটাতে ঢুকে মোমো সেবা হলো।

সেবক কালি মন্দিরের পাশে লাইন দিয়ে বসা বাঁদর গুলোকে খেয়াল করে দেখলাম লালমুখো নয়। অর্থাৎ আসামিজ ম্যাকাক। আর একটু এগোতেই রাস্তার ধারে একজন স্তেপ ঈগলের সাথে দেখা। ক্যামেরাতে শ্রী গণেশ হয়ে গেল।

কালিঝোরার বাঁধটা পেরোতে না পেরোতেই বাম দিকে একটা রাস্তা উঠে গেছে। মোড়ের মাথাতেই পর্যটন বিভাগের একটা সাইন বোর্ড - আমার ভারি পছন্দের। এখন অনেকটাই বিবর্ণ, তবু বাদামি-গলা ধনেশের (Rufous Necked Hornbill) ছবিটা চিনতে ভুল হয় না।

রাস্তা এখন থেকে দ্রুত উপরে উঠেছে। শালের জঙ্গলে রোদ্দুরের আঁকিবুকি। কালিঝোরার বাঁধে আটকে তিস্তার রং পান্না সবুজ। সামনে একটা ধ্বসপ্রবণ এলাকা ছিল না? সন্তোষ জানালেন এখনো আছে। জিটিএ তেমন কিছুই করে নি। তবে 'দিদির' নেকনজরে পাহাড়। নতুন তহবিল এসেছে। কংক্রিট দিয়ে ধ্বস আটকানোর চেষ্টা জারি। নতুন রাস্তা হচ্ছে। সন্তোষ খুশি।

পাহাড়ের পরতে পরতে পাক খেতে খেতে ওই দেখা যায় দূরের লাটপাঞ্চার গাঁ। ওই তো সেই গাছটা -যেখানে গত বারে ধনেশ কর্তা-গিন্নিকে গুডবাই বলেছিলাম। ওই সেই ঢালটা না, যেখানের গড়িয়ে আসা জমির গায়ে সেই কোটরওলা গাছটা ছিল ধনেশ জোড়ার বাসা?

'সেই গাছটা আর নেই স্যার। বছর দুই আগে ঝড়ে ভেঙে গেছে' - সন্তোষ বললেন। সে কি! তাহলে কি তাদের সঙ্গে দেখা হবে না? 'অবশ্যই হবে। ওরা গাঁয়ের অন্যদিকে আর একটা গাছের গায়ে বাসা খুঁজে নিয়েছে' - সন্তোষের আশ্বাস বাণী। আরো আনন্দের খবর হলো নতুন বাসাটা আমাদের থাকার জায়গা থেকে মাত্র দুশো মিটার দূরে। 'ম্যাডামদেরও নামতে অসুবিধা হবে না' - শুনে টুম আর রূপার মুখে আনন্দের ঝিকিমিকি।

ভরদুপুরের রোদ গায়ে মাখতে মাখতে রাস্তাটা ধাঁ করে ধুপি গাছের ছায়ায় ডুব মারলো। গাছের ছায়া ফুরাতেই আবার বাঁক। ওই তো লাটপাঞ্চার হাইস্কুল। তাহলে তো পদমদাজুর বাড়ি এসেই গেল। বাবা! এ যে দেখি তিনতলা হয়ে গেছে। আগের সরু কাঠের বারান্দা এখন কংক্রিটের চওড়া ব্যালকনি। নিচে দাঁড়িয়ে প্রেমদাজু। মুখের হাসি কিন্তু এখনও অকপট, অনাবিল।

আমরা অবশ্য একটা অন্য বাড়িতে থাকবো - পদমদাজুর পৈত্রিক ভিটে। আর একটু নিচে। মহানন্দার জঙ্গলে যাওয়ার রাস্তায়। দোতলায় তিনটে ঘর, নতুন তৈরী। সামনে এক চওড়া বারান্দা। সন্ধ্যেবেলা আড্ডা দিতে খুব কাজে লাগবে।

বারান্দায় দেখা দিব্যেন্দুর সাথে। Cognizantএর চাকরি ছেড়ে বনে জঙ্গলে ঘোরানোর ব্যবসা ফেঁদেছে। সাহসী ছেলে! Facebookএ বন্ধুতালিকায় অনেক আগেই ঢুকে গেছে। এবার চাক্ষুস পরিচয় হয়ে গেল। তিন নম্বর ঘরটাতে ও-ই থাকছে।

পেট চুঁই চুঁই নিয়ে উপরের বাড়িতে উঠতে উঠতে খিদে বেড়ে দ্বিগুণ। গুছিয়ে ভাত ডাল সবজি আর ডিমের ডালনা দিয়ে খ্যাঁটন। আলাপ হলো সুষমা ভাবীর সাথে, পদমদাজুর বউ। গতবারে দেখা হয় নি। সাইবাবার আশ্রমে তিথ্যি করতে গেছিলেন। গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার পদমদাজু অবিশ্যি শিলিগুড়িতে। আর্থিক বছর শেষ হতো চলেছে। হিসেব নিকেশ জমা দিতে হবে না! সন্ধ্যেবেলা ফিরবেন।

এসে হাজির প্রাণেশ। আমাদের গাইড। অমিত আর আমি বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের হোমস্টে থেকে নেমে শিবমন্দিরের দিকে কয়েক পা এগোলেই এক সুঁড়ি পথ নেমে গেছে ধুপি গাছের ফাঁক দিয়ে। আর একটু নামলেই ওক, কাটুস আর নানা গাছের জঙ্গল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। দুশো মিটার যেতে না যেতে একটা পোড়া গাছ পেরিয়ে আমরা ওঁত পেতে বসলাম। প্রাণেশ একটু দূরে একটা ওক গাছের কোটর দেখিয়ে বললো 'এটাই ওদের নতুন বাসা। সকালে এসে একবার ঘুরে গেছে। একটু বসি। দেখি ওরা আসে কি না।' 'ওরা' মানে ধনেশ দম্পতি।

একটু দূরে একটা খুদে পাখি গাছের গায়ে পুরো লুটোপুটি। লেন্সে নজর। চেস্টনাট বেলিড নাটহ্যাচ বুঝি? তা লোভ বাড়লো একটু। জিজ্ঞেস করে ফেললাম - 'ব্রডবিল আসছে?' সঙ্গে সঙ্গে সুরেলা শিস ভেসে এলো। প্রাণেশ বলে উঠলো - 'ওই তো ব্রডবিল'। মাথায় হলুদ কালো হেলমেট খাটিয়ে, নীল লেজ নাচিয়ে, মজার দেখতে সবুজ পাখিটা দেখি একটু দূরেই বসে আছে। সঙ্গে বেশ কিছু বন্ধু। যাক অন্তত একজনের দেখা পাওয়া গেল!

আরো আধ ঘন্টা। কিন্তু মনে মনে 'তোমার দেখা নাই রে' গাওয়া ছাড়া আর কিছু হলো না। প্রাণেশের উসখুসানি দেখে ওকে যেতে বললাম। অমিতের নতুন ক্যামেরার সেটিং ঠিক করতে করতে আরো কিছুক্ষণ। ব্রডবিলগুলো ফেরত এলো। ধনেশ এল না। কমে আসা আলোতে আমরা রাস্তায় উঠে এলাম।

টুম আর রূপা একটু করে খুচরো ঘুম দিয়ে ট্রেন যাত্রার ধকল কাটিয়ে রেডি ততক্ষণে। মহানন্দার জঙ্গলের দিকে এগোলাম। গ্রামের চৌহদ্দি পেরিয়ে আরো খানিক হেঁটে, একটা ঝোরার কাছে কালভার্টে খানিক বসা। ভুতুড়ে কালচূড়া পাখি গুলো ঝুপ করে রাস্তার উপরে নেমে এসে, আবার কি ভেবে উধাও। যখন ফেরার রাস্তা ধরলাম তখন পিছনের পাহাড়ে মেঘ, দিনের আলো উধাও। দূরে তিস্তার জল কিন্তু চক চক করছে তখনও।

হুইস্কি, পাকোড়া আর রূপার আনা বাদামভাজার সাথে খুব আড্ডা হলো বারান্দায়। অমিতদের এই প্রথম এমনি গ্রামে থাকা। কেমন লাগবে সন্দেহ তো ছিলই। আমাদের ভয় হুস করিয়ে তাড়িয়ে দুজনে একবাক্যে ঘোষণা করলো - আবার আসবে এমন গ্রামে।

দূরে তিস্তার ওপারে মশালের মতো কিসব যেন জ্বলে উঠলো একটা একটা করে। অনেকগুলো। একবার সরলরেখায়, একবার ত্রিভুজে। শনশন করে উপরের পাহাড় থেকে ঠান্ডা হাওয়া নেমে এলো। অনেক দূরে গুম গুম করে কিসের আওয়াজ।

এমন পরিবেশে ভূতের গল্প না হয়ে যায় না। জিম করবেটের অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতার কথা চলে এলো। উনিও এমনি আলো দেখেছিলেন না পাহাড়ের অন্য ঢালে? যেখানে কোনো মানুষই থাকে না!

প্রেমদাজু এলেন একটু বাদে রাতের খাবার নিয়ে। জিজ্ঞেস করতে বললেন, ভূত নয়, সামরিক বাহিনীর সিগন্যাল প্রাকটিস। NCC করা অমিত একবার বলে ছিল বটে একই কথা। আমরা তখন কান দিই নি। এমন পরিবেশে এসব কেজো ব্যাখ্যা ভালো লাগে না। একটু গুম হয়ে আমি মুরগির ঝোলে মন দিলাম। চামড়া সমেত রান্না করায় খাসা খেতে হয়েছে।

রাতে ঘুমের মধ্যে আবার গুম গুম আওয়াজ পেলাম। সঙ্গে শোঁ শোঁ করে বাতাসের শব্দ। বুঝলাম ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। দুঃস্বপ্ন ভেবে কম্বলটা টেনে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম।

সাড়ে চারটেয় অ্যালার্ম বাজতে চোখ খুলতে বুঝলাম চারদিকে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। রাতে কখন যেন বিদ্যুৎ চলে গেছে।

টর্চ হাতে ভয়ে ভয়ে বাইরে। বারান্দায় তখন মেঘ আর আঁধার মিশে জমাট। LED বাল্বের ক্ষীণ আলো রাস্তার ওপাশেও পৌঁছাচ্ছে না। ওপাশে, যেখানে ধুপিগাছটা হাওয়াতে ভূতে পাওয়া এলোচুলে বউয়ের মতো মাথা ঝাঁকাচ্ছে। বৃষ্টির ঝাপটায় আমার চুল ভিজে।

পাঁচটা নাগাদ ম্রিয়মান আলোতে দেখলাম পরতে পরতে মেঘ নেমে আসছে উপরের পাহাড় থেকে। তিস্তার বিস্তীর্ণ উপত্যকা কোথায় হারিয়ে একাকার। ধনেশগুলো কোন গাছের আশ্রয়ে? আর ওদের ওই কোটরটা? সেটা জলে ভরে যায় নি তো?

সকালের পাখির খোঁজের দফারফা। কিন্তু পেশাদার দিব্যেন্দু বেরিয়ে গেল ওর টুরিস্ট নিয়ে। কি পাবে এই বাদলায় ও-ই জানে। আমরা ঘন হয়ে চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় বসলাম আড্ডা দিতে। ছাতা মাথায় টুক করে পদমদাজু উঠে এসে গপ্পোতে যোগ দিলেন। কাল সারাদিন শিলিগুড়ি ছিলেন। আজ সকাল হতেই দেখা করতে চলে এসেছেন।

পুরোনো লাটপাঞ্চারের সাথে পরিচয় হলো। ব্রিটিশরা সিঙ্কোনা বাগান করলো। তাই এলো হরেক জাতের লোক পাহাড় থেকে। রাইদের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু গুরুং, তামাং, ছেত্রী, লেপচা - সব্বাই মিলে মিশে আছে।

রাইরা ধনেশগুলোকে দেবতা মানত। তাই ওদের কেউ ছুঁতো না। কিন্তু বাকি পাখিরা গুলতিতে মারা পড়তো। এলো পাখিবাজেরা। পদমদাজুর বাড়িতেই থাকা শুরু করলো। একটু একটু করে তাদের হাত ধরেই বাকি পাখি চেনা, ভালোবাসা। গ্রামে গুলতি বিক্রি বন্ধ। গাঁয়ের স্কুলে বাচ্ছারা পাখি চিনতে শিখছে। পাখিরা আনছে নতুন রুজি রুটির সন্ধান। বছরের সাত-আট মাস এখন পাখিবাজেদের আনাগোনা। হোমস্টে মালিক, গাড়িচালক, মুরগিওয়ালা, পাখির গাইড - সকলেই খুশি।

পদমদাজু চলে গেলেন। ঝিরঝিরে নাছোড়বান্দা বৃষ্টি গেল না। পুরি সবজির নাস্তাটাই মন দিয়ে করলাম। কিন্তু মন খারাপ কাটলো না। আজকের দিনটাই তো আসল ছিল।

ঘরে বসে থাকলে মন খারাপ বাড়বে। তাই ছাতা মাথায় রাস্তাতে আমরা। প্রাইমারি স্কুলের সামনে পাক খেয়ে রাস্তা চললো উপর। ওই তো ডান দিকে সরু রাস্তা নেমে গেছে পুরোনো ধনেশ বাসার দিকে। এখন বৃষ্টিতে পিছল, কুয়াশায় ধূসর। আরো এগোই। হাইস্কুলবাড়ি ভিজছে। ছোট্ট পোস্ট আপিস, গোর্খাল্যান্ডের মলিন স্মৃতি জীর্ণ সাইনবোর্ডে। সিঙ্কোনা শুকানোর গুদাম, এখন ফাঁকা, অঝোর ধারায় ভিজছে। উপরে উঠে গেছে অহলদাড়ার রাস্তা। একটু ভাঙা।

গুটিগুটি নেমে এলাম সুষমাভাবীর রান্নাঘরে। চা আসতে দেরি হলো না। একে একে আরো অনেকে। গপ্পো বৃষ্টির। একদল বিদায় নিচ্ছেন। কাল দেখে ফেলেছেন ধনেশ, স্কারলেট ফিঞ্চ। আমরা হিংসুটের মতো কটমট করে তাকালাম। কি অন্যায়! আমরা এখনো ধনেশই দেখতে পাই নি।

দুপুরের খাবার খেতে খেতে টের পেলাম বৃষ্টি কখন মেঘের মধ্যে উধাও। ডেকে নিলাম সন্তোষ তামাংকে। মহানন্দার জঙ্গলের দিকে রওনা। পথে দেখি খাদের মধ্যে একটা লালফুলের গাছে জড়াজড়ি করে একজোড়া বারড কুকু ডাভ বসে আছে। সিঙ্কোনা গাছের বাগান শুরু। পাখিগুলো একদম বসতে চায় না। তেতো গাছ বলে কি?

রাস্তাটা বাঁক খেয়ে একটা ধুপিগাছের বীথি হয়ে গেছে, যার শেষে জঙ্গলটা শুরু। আমরা পায়ে হেঁটে এগোলাম। গোটা কতক Shrike কুয়াশার মধ্যে বসে আছে।

রেঞ্জ আপিসের কোয়ার্টার গুলো পেরিয়ে এলাম। সুলতান টিটের ডাক শুনে উপরে নজর করতেই দেখা হলো। ছবি খুব কিছু এলো না। কিন্তু কালোমাথায় হলুদ ঝুঁটি বাগিয়ে তারা বিজ্ঞের মতো আমাদের দিকে তাকালো। লাটকোঠি বাংলো চত্বর পাখি ফাঁকা। ফুলগুলো শুধু নির্লজ্জের মতো রঙ্গিন হয়ে কুয়াশাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে। কি অপূর্ব গন্ধ তাদের!

ফেরার পথে কুয়াশা উধাও। ব্ল্যাক বুলবুল আর স্কারলেট মিনিভেট গুলো সেই আনন্দে একটু ঘুরে গেল।

ফিরে এসে আমরা এক চক্কর ঘুরে এলাম ধনেশের বাসা থেকে। কুয়াশা এখন এদিকে নেমে এসেছে। গাছটা ভালো করে দেখাই গেল না।

উপরে রাস্তাতে উঠে দেখি শিবমন্দিরের উপর ঝুপসি গাছখানা পেত্নীর মতো হাতছানি দিচ্ছে গাঢ় কুয়াশায়। একটা গাড়ি ভয়ে ভয়ে পেরিয়ে গেল। তার কানা টেললাইটের আলো একচক্ষু দানবের মতো চেয়ে আছে। আমরা কিন্তু ‘লেবুর পাতা করমচা, যা বৃষ্টি ধরে যা’ মন্তর পড়ে ঠাকুরকে ডেকে নিলাম।

রাতের খাবার যখন খাচ্ছি, বিজলি চলে গেল। বৃষ্টি আবার ফিরে এলো নতুন শক্তিতে।

রাত সাড়ে তিনটের সময় ঘুম ভেঙে দেখি কোনো শব্দ নেই। জানলার বাইরে আকাশ ভরা তারা। শিবঠাকুর বুঝি সন্ধ্যের প্রার্থনা শুনেছেন।

ঠিক সাড়ে পাঁচটায় প্রাণেশ এসে হাজির। দুজনে পায়ে পায়ে চললাম নার্সারির দিকে। আকাশ পরিস্কার।

রাস্তাতে দেখে ফেললাম লেসার আর গ্রেটার ইয়েলোনেপ কাঠঠোকরা। হঠাৎ সামনে উঠে এলো ব্রডবিল। একটা বারড আউলেট গোল গোল চোখে আমাদের মেপে নিল। নার্সারির কাছে চেস্টনাট বেলিড নাটহ্যাচ আর রকথ্রাশ পেলাম। প্রাণেশ রেড হেডেড ট্রোগোনের লোভ দেখিয়েছিল। দেখা অবিশ্যি পেলাম না।

ফেরার পথে অমিত-রূপা-টুমের সাথে দেখা। সকালের খাবারটা রান্নাঘরেই খেয়ে নিলাম।

অমিত আর আমি প্রাণেশের সাথে শিবমন্দিরের কাছে এসে বামদিকের জঙ্গলে ঢুকে গেলাম। একটা ridge দুদিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে। ডানদিকের ঢালে আরও নিচে ধনেশের বাসা। পায়ে চলা রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে।

আওয়াজটা কিন্তু এলো বামদিক থেকে। নির্ভুল পুরুষ ধনেশের ডাক। সাঁই সাঁই করে ডানার আওয়াজ করে উড়ে এলো মস্ত পাখিটা। বসলো একটু নিচে এক গাছে। আমরা ছুটে নেমে এলাম ওর তলায়।

মিনিট দুয়েক আমাদের মেপে আবার উড়ে গেল বামদিকের ঢালে। বউকে আমাদের নিরীহ উপস্থিতি বুঝিয়ে বলতে গিন্নি এবার উড়ে বাসার কাছে বসলেন। স্ত্রৈণটা পিছু পিছু।

এত সময় আমরা একা ছিলাম। কিভাবে না জানি টের পেয়ে লাটপাঞ্চারের সব পাখিবাজ ঢাউস কামান বাজুকার সাইজের লেন্স নিয়ে ridgeটার উপর হাজির। ঈষৎ ঠেলাঠেলি। সংশপ্তক বাহিনী প্রায়। পদমদাজুর ভাইপো প্রতীকও হাজির তার ট্যুরিস্ট নিয়ে। সে অবশ্য অতি ভদ্রভাবে ছবি তোলাচ্ছে।

বেগতিক দেখে প্রাণেশকে ইশারা করলাম নিচে যেতে। সে দেখি বুঝেও বোঝে না। আমি পরোয়া না করে চুপি চুপি নিচের রাস্তায়। অমিত পিছু পিছু। অগত্যা প্রাণেশও। ছুটতে ছুটতে ভাবছি যদি টুমকে একটু খবর দেওয়া যেত। এমন সুযোগ কি আর পাবো?

ও বাবা গিয়ে দেখি নিচে টুম একেবারে বাসার কাছেই দাঁড়িয়ে। কিছু সিক্সথ সেন্স বাবা! আমি সকাল থেকে ছুটোছুটিতে হয়রান। আর পাখিগুলো যখন বাসার কাছে, ঠিক তখন ও প্রতীকের দাদাকে সঙ্গে নিয়ে হাজির।

যাকগে। 'সতীর পুণ্যে পতির পুণ্য' এই ভেবে গদাম গদাম করে দিলাম শ-তিনেক exposure ছুঁড়ে। অমিতও মনের সুখে ছবি তুললো। ওদিকে নাটকের হিরো-হিরোইনও মওকা বুঝে নানা নখড়া দেখতে থাকলো।

তবে দেখলাম ধনেশ কর্তারই বেশি গরজ। বাসা পরিস্কার, গিন্নির ঘাড় চুলকে দেওয়া সবই তার দায়িত্ব। এসব উদাহরণ সংসারের জন্যে ঠিক নয় ভেবে টুমকে বললাম -'চলো চলো, ওদের বেশি ডিস্টার্ব করা ঠিক না'। মুচকি হেসে টুম আমার পিছনে দেখালো।

উরিব্বাস! আমাদের দেখে পুরো সংশপ্তক বাহিনী নেমে এসেছে। (শুধু ওই হাউত্জারধারীরা আর পারে নি। ট্রাইপড ঘাড়ে নেমে থিতু হতে হতে উড়ে ধনেশ উড়ে যাবে যে!) 'ডিস্টার্ব' মার্কা যুক্তিটা আর কাজে লাগলো না। জনাদুই অতি উৎসাহী সংশপ্তক গোলাপি জামা পরে আরো নিচে। গাইডরা তাদের অনুরোধ করে উপরে তুললো।

মন ভরে দেখলাম পাখিদুটো। ওদের জন্যেই তো আসা। কালকের নষ্ট দিনের কষ্ট এক লহমায় মুছে গেল।

উৎসাহভরে চারজন মিলে একটা গাড়ি ধরে চললাম মহানন্দা। বেলা চড়ে গেছে। জঙ্গলের এক ছোট্ট বাঁধে নতুন বর্ষার জল পেয়ে একদল ব্যাঙ গাল ফুলিয়ে ঘ্যাঙর ঘ‍্যাং করছে। দূরে এক ঝাঁক মিনিভেটের ওড়াউড়ি। একটা লিফ বার্ড পাতার আড়ালে।

পায়ে পায়ে উঠে এলাম লাটকোঠির উঠোনে। বেড়া পেরিয়ে এক বাঁশঝোপের কাছে দেখি প্রতীক আর তার ট্যুরিস্ট ঘাপটি মেরে। এক্কেবারে কাছেই এক পেল ব্লু ফ্লাইক্যাচার। বড় আনন্দ।

খাওয়ার পর দেবেন রাই এলো গাড়ি নিয়ে। আমাদের NJP ছাড়বে। প্রাণেশ আর উজ্জ্বল যাবে সাথে।

প্রথমে অহলদাড়া। অমিত আর রূপা মুগ্ধ তিনশো ষাট ডিগ্রি খোলা দৃশ্য দেখে। আমাদের দুজনের স্মৃতিচারণ আড়াই বছর আগের এক দারুণ রাতের।

নামথিং পোখরি। লেক শুকনো। অমিতের স্যালামান্ডার দেখা হল না। তার বদলে ওদের দেখলাম লেকের ধারে জঙ্গলের মধ্যে একটা ছোট্ট রঙিন শিবমন্দির। মেঘ তখন আমাদের গায়ে আবার লেপ্টে।

কার্সিয়াংয়ের রাস্তা ধরে থামদাড়া। নেমে এলাম প্রাচীন চোর্তেন চর্চিত এক চত্বরে। সামনে দুশো বছরের পুরোনো এক লেপচা গুমফা। মাটি আর পাথরের তৈরী। উপরের নতুন টিনের ছাদ ছাড়া বাকিটা কিছুই বদলায় নি। নিংমা ধারার মূর্তি সব ভিতরে।

আরো ওঠা। কুয়াশা আরো গাঢ়। প্রাণেশ অসুস্থ হয়ে সামনের সিটে আমার পাশে। মালদিরাম চাবাগান এসে গেল। উপরের রাস্তা ডানদিকে বাগোরা হয়ে কার্সিয়াং যাবে। আমরা নিচে নামবো।

সরু রাস্তা দ্রুত নিচে নেমেছে। অপূর্ব ম্যানিকিউর করা চায়ের ঝোপ ঢাল বেয়ে উপরে আর নিচে। সামনের গাছে একটা ঈগল। উল্টোদিকে একটা ধ্বস নামা পাহাড়। লাটপাঞ্চার থেকেও দেখা যায়। একটু ট্রেক করে গেলে নাকি ঘোরাল দেখা যায়। পরের বার তো যেতেই হবে তাহলে।

একটু পরে বাঁকের কাছে মহানন্দা স্যাংকচুয়ারি বিস্তীর্ন হয়ে নিচে। আমরা আরো নিচে এসেছি। গরম বাড়ছে। সবুজ চা-বাগানের ঢালে মাঝে মাঝে ছবির মতো সাদা চা-কারখানা। শিবখোলার কাছে এলাম। এক ঝাঁক ময়না হলুদ নোলক পরে গাছে বসে। একটা পিগমি কাঠঠোকরা শিরিষ গাছে পোকার সন্ধানে। শিবখোলার মন্দিরে ঈষৎ বিচরণ।

রংটংএ নেমে এলাম হিলকার্ট রোডের উপর। এখানে ভালো বার্ডিং হয়। কিন্তু আজ সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। তাই টয় ট্রেনের ছোট্ট স্টেশনে ঘোরাঘুরি। চা মোমো। এখন থেকে শুকনার জঙ্গল পেরিয়ে শিলিগুড়ি আধঘন্টা মাত্র।

আলো শেষ হয়ে এলো। বেড়ানোও।

Comments

Popular posts from this blog

Glowing Goa 2019

Loris Land: Thattekad 2019

In the Land of Padmasambhava